নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এত কঠোর নিরাপত্তা ও নির্দেশনার পরও রোহিঙ্গাদের হাতে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পৌঁছে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়াও পিরোজপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিদ্যমান ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন নিবন্ধিত রোহিঙ্গারাও ভোটার হয়ে যাচ্ছেন। সারাদেশে ইসির সতর্কতাও কাজে আসেনি। কীভাবে এটা হচ্ছে—সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ কমিশন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, ‘ভোটার হতে রোহিঙ্গাদের স্থানীয়ভাবে কেউ না কেউ সহযোগিতা করছে। বিশেষ করে ভোটার হওয়ার আগে রোহিঙ্গারা কীভাবে অনলাইনে জন্মসনদ এবং চেয়ারম্যান-কাউন্সিলর থেকে নাগরিক সনদ পাচ্ছেন তার তদন্ত জরুরি। পিরোজপুরে আটক রোহিঙ্গা নিজের বাবা-মাও বানিয়ে ফেলেছেন। এই ঘটনাটি কমিশন সিরিয়াসলি নিয়েছে। বরিশালের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা ডাটাবেজে নাম থাকার পরও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কীভাবে ভোটার হলো তা-ও তদন্তের আওতায় আনা হচ্ছে। এই ঘটনায় যারা জড়িত থাকবে কাউকে ছাড় দেব না।’
সক্রিয় সিন্ডিকেট :ইসি সূত্রে জানা গেছে, এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশে ভোটার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত রয়েছে বলে তথ্য পেয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরই মধ্যে এসব ঘটনায় জড়িত ইসির বর্তমান ও সাবেক প্রায় ৩০ কর্মচারীকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সূত্র জানায়, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের আত্মীয় পরিচয়ে শনাক্ত করেন স্থানীয়রা। জমা দেন স্থানীয় চেয়ারম্যানের নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট। জনপ্রতিনিধিরা তাদের প্রকৃত নাগরিকের স্বীকৃতি দেওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। চক্রটি চট্টগ্রামে সুবিধা করতে না পেরে ওই এলাকা ছেড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের ভোটার করছে। ভোটার হতে হলে চট্টগ্রামের বিশেষ এলাকার বাইরে একজন ভোটারকে জন্মসনদ বা সার্টিফিকেট, নাগরিক সনদ, বাবা-মায়ের এনআইডি, বাসার ইউটিলিটি বিলের কপি জমা দিতে হয়। এসব কাগজপত্র তৈরি করার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের সহায়তা করছে সিন্ডিকেটটি। এই সিন্ডিকেট মাঠপর্যায় থেকে ইসির সচিবালয় পর্যন্ত সক্রিয়। নতুন ভোটার করার পর ইসির কাছে সংরক্ষিত ১১ লাখ ২২ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ডাটাবেজ যাচাই-বাছাই করা হয়। গত বছর ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার সময় অন্তত ৬০ জনের মতো রোহিঙ্গা ভোটার হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। গত বছর ইসির সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর চট্টগ্রামের বিশেষ ৩২ এলাকা ছাড়াও সারাদেশে রোহিঙ্গাদের ভোটার না করার ব্যাপারের কঠোর নজরদারির নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু চক্রটি এতই শক্তিশালী যে ইসির নির্দেশনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা ডাটাবেজকেও ব্যর্থ করে দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে এক থেকে দেড় লাখ টাকার লেনদেন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইসির একাধিক কর্মকর্তা।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, ইসি ঘোষিত ৩২টি বিশেষ উপজেলার বাইরে গিয়ে ভোটার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। এক্ষেত্রে তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কেননা এক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা প্রকৃত বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে ভোটার হচ্ছেন। প্রকৃত নাগরিকের মতো স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান থেকে নাগরিক সনদ ও জন্মসনদ সংগ্রহ করছেন তারা। এই জন্মসনদ দিয়ে পাসপোর্টও তৈরি করছেন রোহিঙ্গারা। এরই মধ্যে সৌদি আরবে কয়েক হাজার রোহিঙ্গার হাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট রয়েছে।
নিবন্ধিত রোহিঙ্গাও ভোটার!
গত রবিবার পিরোজপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ভাণ্ডারিয়া থেকে মো. জামাল (২১) নামে এক রোহিঙ্গাকে আটক করে। আটককৃত জামাল গত বছর ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় ভোটার হয়েছিলেন। ১১ লাখ ২২ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের একজন তিনি। জামাল পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার ২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ভোটার হন। তার এনআইডি নং-১৯৯৭৭৯১১৪১১০০০৫১০, ভোটার সিরিয়াল নম্বর-১৪৫৩, ভোটার নম্বর-৭৯০৫১১০০০২৩৬। পিতার নাম মো. মিজান রহমান, মাতার নাম শাহিনুর বেগম। শিক্ষাগত যোগ্যতা-অষ্টম শ্রেণি। জেলা পুলিশ জানিয়েছে, জামাল রবিবার পিরোজপুর আঞ্চলিক অফিসে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করার পর ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার সময় সার্ভারে দেখা যায় সে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালি রিফিউজি ক্যাম্পের একজন শরণার্থী। রোহিঙ্গা জামালের রিফিউজি পরিচয় নং ১৩২২০১৮০১২০১৪৫৮৫২। এই ঘটনায় ভাণ্ডারিয়ার পৌর মহিলা কাউন্সিলর ও কথিত বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
গত বছর চট্টগ্রামে ভোটার তালিকায় ৪৬ জন রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করা হয়। রোহিঙ্গা নারী লাকি আটকের পর রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার তথ্য বেরিয়ে আসে। চট্টগ্রামের একটি থানা নির্বাচন অফিসে তদন্তে এক এলাকার ফরমে অন্তত ১৪টি থানায় রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। নিয়মবহির্ভূতভাবে একই এলাকার একটি ভোটার বইয়ের ৭৪টি নিবন্ধন ফরমের মাধ্যমে অন্তত ৬ জেলার ১৪টি থানা নির্বাচন অফিস থেকে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা হয়েছে। একই নম্বরে একাধিক ব্যক্তি ভোটার হয়েছেন।
এছাড়া প্রথম হালনাগাদে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন উপজেলার ৫০ হাজার রোহিঙ্গা ভোটার শনাক্ত হয়। উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের পর ৪২ হাজার রোহিঙ্গা ভোটারের নিবন্ধন বাতিল করা হয়। ২০১২ সালেও কয়েকটি এলাকায় রোহিঙ্গা ও অবৈধ নাগরিকের অভিযোগে ১৭ হাজার রোহিঙ্গাকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয় কমিশন। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সুপারিশে ৯৮ জন রোহিঙ্গাকে ভোটার তালিকা থেকে কর্তন করা হয়।
এ বিষয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন) আবদুল বাতেন ইত্তেফাককে বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার হতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। আমরা এখন রোহিঙ্গা শনাক্ত করতে দুটি ডাটাবেজ ব্যবহার করছি। প্রথমত নতুন করে যারাই ভোটার হচ্ছেন তারা রোহিঙ্গা কি না তা শনাক্ত করতে ১১ লাখ ২২ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের ডাটা চেক করা হচ্ছে। সেখানে রোহিঙ্গা হিসাবে নো ম্যাচিং আসলে পরবর্তী সময়ে ইসির ডাটাবেজ চেক করে নো ম্যাচিং আসলেই কেবল ভোটার হিসাবে কেন্দ্রীয় সার্ভারে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
পিরোজপুরে সেই রোহিঙ্গার কথিত মা আটক
পিরোজপুর অফিস ও ভাণ্ডারিয়া সংবাদদাতা জানান, পাসপোর্ট করতে এসে পিরোজপুরে রোহিঙ্গা যুবক জামাল আটকের ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার কমিশনের নির্দেশে বরিশাল ও পিরোজপুরের নির্বাচন কর্মকর্তারা ভাণ্ডারিয়ায় এসে দিনভর অনুসন্ধান চালিয়েছেন। এদিকে জামালকে নিজ ছেলে পরিচয় দেওয়া ভুয়া মা শাহিনুর বেগমকে পিরোজপুরের গোয়েন্দা পুলিশ আটক করেছে।
জেলা নির্বাচন অফিসার আবী খান শাহানুর খান ইত্তেফাককে জানান, ভাণ্ডারিয়া ও রাজাপুরের একটি চক্র ভাণ্ডারিয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসে জামালের এনআইডি ও ভোটার পরিচয় প্রক্রিয়াকরণ এবং ভাণ্ডারিয়া পৌরসভা ও রাজাপুরের নলবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ভুয়া কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে।
এ ঘটনায় পুলিশের মামলার আসামি ভাণ্ডারিয়া পৌর মহিলা কাউন্সিলর বেবি আক্তার, রোহিঙ্গা জামালের কথিত বাবা মিজানুর রহমান সিকদার ও কথিত মা শাহিনুর বেগম এবং যে বিদ্যালয় থেকে ভুয়া শিক্ষা সনদ সংগ্রহ করা হয়েছে তার প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম পলাশসহ এই বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষককে উপজেলা নির্বাচন অফিসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একপর্যায়ে শাহিনুর বেগমকে আটক করা হয় বলে জানান মামলার বাদী গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মো. দেলোয়ার হোসেন। এদিকে রোহিঙ্গা যুবক জামালকে গত সোমবার আদালতের মাধ্যমে পুলিশ জেল হাজতে পাঠিয়েছে।
Leave a Reply