করোনার ভয়াল আঘাতে ভেঙেচুরে তছনছ করে দিচ্ছে বিশ্ব। ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্য সেবার খুঁটি। একে রুখার উপায় অজানা। মহামারির মৃত্যুগ্রাসে অসহায় বন্দি মানুষ। এ যেন মৃত্যুর অপেক্ষায় বেঁচে থাকা। এর শেষ কোথায়? ঝড় হয়তো একসময় থামবে, প্রকৃতিও শান্ত হবে। কিন্তু আগামী বিশ্ব কি সুরক্ষিত? আবার ফিরে আসবে না-তো ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস? এমন প্রশ্ন এখন বিজ্ঞানীদের মনে। উৎপত্তিস্থলে উহান এরই মধ্যে করোনামুক্ত হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। সেখানে নতুন কোন সংক্রমণের খবর বেশ কয়েকদিন ধরে নেই। চীনে ভাইরাসের সংক্রমণ কমলেও থামেনি। বিপুল জনসংখ্যার দেশে ফের এই ভাইরাস মহামারি আকারে ফিরে আসবে কি-না সেটাও অজানা।
ঝড়ের আগে শান্ত হয় প্রকৃতি, করোনা তারই অশনিসঙ্কেত নয় তো!
সুনামির সময়েও বড় বিপর্যয় হয়েছিল। প্রকৃতির সেই রোষও সামলে ওঠা গিয়েছিল। তবে তার প্রভাব রেখে গিয়েছিল বিশ্বে। কোথাও একটা ভিত নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বজোড়া এই মহামারীও তেমনই কোনও ইঙ্গিত দিচ্ছে না তো? সেই চিন্তাই করছেন বিজ্ঞানী-গবেষকরা। ‘ল্যানসেট মেডিক্যাল জার্নাল’ -এ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও তার প্রতিরোধ নিয়ে অনেক গবেষণাপত্রই ছাপা হয়েছে। সংক্রমণ-পরবর্তী পর্যায়ের পরিস্থিতি নিয়ে আগাম সম্ভাবনার কথাও বলেছেন বিজ্ঞানীরা।
ফ্রান্সের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও এপিডেমোলজিস্ট অ্যান্টনি ফ্ল্যাহল্ট বলেছেন, যে কোনও বড় ঝড় ওঠার আগে প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়ে যায়, এক্ষেত্রেও তেমনটাই হচ্ছে। চীনে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়েছিল গত বছরের মাঝমাঝি। মানুষ মরতে শুরু করেছিল তখনই। পুরো ব্যাপারটাই সুকৌশলে চাপা দিয়েছিল চীন। প্রথম মৃত্যু দেখানো হয় ডিসেম্বরে। ততদিনে কিন্তু ভাইরাস আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। তার বড় ঝাপটা আসে জানুয়ারি থেকে। একধাক্কায় শয়ে শয়ে মানুষ মরতে শুরু করে। চীন থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। কী বিপদ ঘটছে সেটা বোঝার আগেই মহামারি শুরু হয়ে যায়। অজানা এই শত্রুকে রোখার সময়ও পায় না মানুষ। এটাই হল সেই বিপদের ইঙ্গিত। অ্যান্টনির কথায়, ‘আমরা উদ্বেগে রয়েছি, এখন যে ঝড় চলছে সেটা আরও বড় বিপর্যয়ের সঙ্কেত দিচ্ছে না তো! সংক্রমণ একটা পর্যায়ে থেমে গেলেও এর পরবর্তী প্রভাব কিন্তু মোটেও সুখের হবে না। তার জন্য দায়ী থাকবে মানুষের অসচেতনতা ও রোগ লুকিয়ে যাওয়ার মানসিকতা।’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্কর পরিণতি সামলে ওঠার মাঝেই বিশ্বজুড়ে মহামারি হয়ে দাঁড়ায় স্প্যানিশ ফ্লু। মৃত্যু হয় পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষের। সেই ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছিল বিশ্ববাসীকে। ১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সালের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস অর্থোমিক্সোভিরিডি পরিবারের একটি প্রাণঘাতী ভাইরাল স্ট্রেন দাপট দেখিয়েছিল গোটা বিশ্বে। সেই সংক্রমণ থামলেও কিন্তু শেষ হয়নি। ১৯৫৭-৫৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস (টাইপ-এ, এইচ২এন২)-এর প্রভাবে এশিয়াতে ১০-১৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। সেই মহামারীর নাম ছিল ‘এশীয় ফ্লু’। সেই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের থেকেও ভয়ঙ্কর বিটা-করোনাভাইরাসের স্ট্রেন সার্স-সিওভি-২ । বিবর্তনের ধারায় এবং মানুষের সচেতনতার অভাবে প্রকৃতি বদলে ভাইরাসরা অনেক আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন উৎস খুঁজে নিচ্ছে। মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধের শক্ত দেয়াল ভেঙে ফেলার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক বদলও ঘটিয়ে ফেলছে। এই রোগকে রোখার প্রতিষেধক তৈরির আগেই তাকে প্রতিরোধ করার কৌশল আয়ত্ত করে নিচ্ছে ভাইরাস। চিন্তার বিষয় এখানেই।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, চীন যদি প্রথমেই ভাইরাসের সংক্রমণের কথা বিশ্বকে জানিয়ে দিত, তাহলে এত বড় বিপর্যয় হত না। এতদিনে সেই ভাইরাসকে রোখার উপায় আয়ত্ত করে ফেলা যেত। সংক্রমণ ছড়ানোর পরেও তার সঠিক পরিসংখ্যান চেপে রেখেছিল চীন, এখন তারা সেই ঝড় সামাল দিতে পারছে না। আরও বড় ব্যাপার হল চীনের এই স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের কারণে আগামী দিনেও তারা কিন্তু খুব একটা সুরক্ষিত নয়।
১৯২০ সালে স্কটল্যান্ডের উইলিয়াম ওগিলভি কারম্যাক ও আন্ডারসন গ্রে ম্যাককেন্ড্রিক মহামারীর চরিত্র বোঝাতে একটা মডেল তৈরি করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, যে কোনও মারণ রোগজনিত মহামারীকে থামানো গেলেও শেষ করে ফেলা যায় না। তার কারণ মানুষের শরীরের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখে যায় সেই মারণ জীবাণু। হয়তো তার প্রভাব কমে, কিন্তু পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় না। এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী মানুষ। তাদের অসচেতনতা এবং অসংযমী জীবনযাত্রা। কিছু বছরের জন্য সেই রোগের প্রভাব থেমে গেলেও একটা সময় সে ফের মাথা চাড়া দেয়। তখন তার প্রভাব হয় আরও বেশি প্রাণঘাতী। কারণ ততদিনে বিবর্তনের সেই চরম পর্যায়ে চলে যায় মারণ জীবাণুরা। ঠিক এমনটাই হয়েছে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও।
জেনেভা ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল হেলথ বিজ্ঞানী ফ্লহল্ট বলছেন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সকলের সমান হয় না। যাকে হার্ড ইমিউনিটি বলে অর্থাৎ এক শ্রেণির লোক ঠিক সময় ভ্যাকসিন বা ড্রাগ নিয়ে নিজেদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে ফেলেন। কিন্তু সেই সংখ্যা সীমিত। সংক্রমণ তখনই মহামারীর চেহারা নেয় যখন একজন আক্রান্তের থেকে আরও অনেকে সংক্রামিত হন। একজন রোগীর থেকে যদি পাঁচজন সুস্থ মানুষ আক্রান্ত হন তাহলে সেই অনুপাত বাড়তে বাড়তে বিশাল চেহারা নেয়। চীনের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছে। সেখানকার বিপুল জনসংখ্যা, তাদের খাবারের ধরন, একগুঁয়ে মনোভাব এবং সংক্রমণ চেপে রাখার মানসিকতার কারণেই এখন বিশ্বে মহামারি হয়ে গেছে কোভিড-১৯। ফ্লহল্ট বলেছেন, সংক্রমণ তখনই কমবে যখন সঠিক কোয়ারেন্টাইন চলবে, সংক্রমণ রোখার ভ্যাকসিন আসবে ও সামাজিক মেলামেশায় লাগাম পরানো যাবে। একজন আক্রান্তের থেকে যদি মাত্র একজনই সংক্রামিত হন, তাহলে বিপুল হারে সংক্রমণ রোখা সম্ভব হবে।
চীনেই ফেরে জেগে উঠবে করোনাভাইরাস?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এমার্জেন্সি এক্সপার্ট মাইক রায়ান সম্প্রতি এমনই একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, লকডাউন ভাল কিন্তু কার্যকরী নয়। গণজমায়েত বন্ধ করে পরস্পরকে দূরে রেখে সংক্রমণ ঠেকানো সব সময় সম্ভব হয় না। কারণ হিসেবে তাঁর মত, এমনও হতে পারে ভাইরাসের উপসর্গ কারও মধ্যে ধরা পড়েনি অর্থাৎ তিনি ভাইরাসমুক্ত। লকডাউনের কারণে তিনি পরিবারের বাকিদের সঙ্গে একই বাড়িতে বন্দি রইলেন। পরে দেখা গেল সেই পরিবারের সকলের মধ্যেই সংক্রমণ ছড়িয়েছে। সেখান থেকে আরও অনেকের মধ্যে। একটা সময় দেখা যাবে, মানুষের মধ্যেই সুপ্ত হয়ে থাকা ভাইরাসের সংক্রমণ ফের মাথাচাড়া দিয়েছে। তখন পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হবে। সেই সংক্রমণ ফের মহামারি হয়ে ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে। চীনে এই মুহূর্তে সংক্রমণ কমলেও, ফের সেটা বড় আকার নেবে কি-না সেটাই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজ্ঞানী-গবেষকদের।
একই কথা বলেছেন ফ্রান্সের বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক ফ্রাঙ্কোসিস ব্রিকেয়ারও। তিনি বলেছেন, সংক্রমণ থামে না, একটা বিরতি নেয় মাত্র। যদি মানুষ রোগ পুষে রাখে তাহলে কয়েক মাস, এমনকি কয়েক বছর বাদে ফের সেটা মাথা চাড়া দেয়। সেই সময় আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে ভাইরাসের সংক্রমণ।
অস্ট্রেলিয়ার সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ শ্যারন লেউইন বলেছেন, ‘ভাইরাস ফের মাথাচাড়া দেবে কিনা সেটা বলা যাচ্ছে না। সার্স (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম) ভাইরাসের সংক্রমণও ঠেকানো গিয়েছিল, কিন্তু রোখা গেল কি? সার্সও বিটা-করোনারই এক পরিবারের সদস্য। সেই পরিবারেরই অন্য সদস্য সার্স-কোভি-২।’ করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর ভ্যাকসিন আসতে এখনও এক বছর সময় লাগতে পারে। ততদিনে কী ভেল্কি দেখায় এই ভাইরাস সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
Leave a Reply